শহর তো শুধু নয়, শক্ত সমর্থ পেটানো চেহারার সে মারাঠি ব্যক্তি চলে যেতেন গাঁয়ে গঞ্জে। মাঠে-ময়দানে টেনে আনতেন খেতে না পাওয়া কঙ্কালসার মানুষগুলোকে। তিনি দেখেছিলেন, তাদের পেটে খিদের আগুন। চোখে আগুন প্রতিবাদের, ক্ষোভের। বাল গঙ্গাধর তিলকের অনেক আগেই, তিনি মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, স্বরাজের ভাবনা।
দুর্ভিক্ষে মরতে থাকা অচ্ছুৎ, গরিব, হাড়-হাভাতে মানুষগুলোর মনে আগুন লাগলো। ভিড়ে গেলেন সেই পেটানো চেহারার গোঁফ দাঁড়িওয়ালা মারাঠি লোকটির সঙ্গে। সাধুর বেশে অনেক সময়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। অনেকে তাঁকে কাশীকা বাবা বলেও ডাকতেন। শিবাজীর মাওয়ালী সেনাদলের আদলে তৈরি হল দল, রামোসি। গুলটেকরি পাহাড়ের গুপ্ত ঘাঁটিতে তৈরি হল দল। ভারতের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী দল। যার মাথায়, কাশীকা বাবা ওরফে বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে। তিনি ভুলতে বসা এক কিংবদন্তি। যাঁর নামে এক সময় ভয়ে কাঁপত ব্রিটিশ সেনাদল।
ইংরেজদের শোষনে শুধু বাংলা-বিহারও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েনি। প্রবল সমস্যায় পড়ে আরও বেশ কয়েকটি রাজ্য। মহারাষ্ট্রে সমস্যা ছিল মারাত্মক। মৃত্যুমিছিলেও চলতে থাকে জোর করে খাজনা আদায়। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গ দেয় কিছু জমিদার। ফসল গুদামে আটকে রেখে, বাজারে চাহিদা বাড়িয়ে দাম লোটার কারসাজি শুরু তখন থেকেই। এই সময়েই ময়দানে নামেন বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে।
অধুনা মহারাষ্ট্রের রায়গড়ের পানভেলে সিরধোঁ গাঁয়ে জন্ম বাসুদেবের। কাজের তাগিদেই পরে পুনেতে যাওয়া। সেখানে সেনা হিসেব বিভাগে প্রায় বছর পনেরো কাজ করেছেন। পুনেতেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় কুস্তিগীর ও বিপ্লবী লাউজি বাস্তব সালভের সঙ্গে। বিপ্লবের আগুনটা তিনিই জ্বেলে দেন বাসুদেবের মধ্যে। ১৮৭৬ সালে মহারাষ্ট্র যখন দুর্ভিক্ষ নুয়ে পড়েছে, তারপর থেকেই চাকরি ছেড়ে মাঠে ময়দানে নেমে ইংরেজবিরোধী প্রচার শুরু করেন বাসুদেব ওরফে সবার কাশীকা বাবা। ১৮৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হল প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী দল, ২০০ স্ট্রং মিলিশিয়া।
শুরুটা হল ডাকাতি দিয়ে। বেশ কয়েকটা গ্রামের অবস্থাপন্ন বাড়ি, তারপর ইংরেজদের খাজাঞ্চিখানা। টাকা বিলি করে দিতেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের মধ্যে। ইংরেজরা পাল্টা আঘাত হানলে, শোনা যায় বেশ কিছুদিন তিনি পুনে শহরকে ব্রিটিশ শাসনমুক্তও করেন।
শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের চাপে অবশ্য পুনে ছেড়ে হায়দরাবাদে চলে যান বাসুদেব। সেখানে নতুন করে সংগঠন গড়ে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ধার বাড়াতে শুরু করলেন। ব্রিটিশ সেনার মেজর হেনরি ড্যানিয়েল আর নিজামের পুলিস সুপার আবদুল হক অনেক চেষ্টা করেও বাসুদেবকে বাগে আনতে পারেননি। তাঁকে ধরার জন্য এক লক্ষ টাকা আর্থিক পুরষ্কারের ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। পাল্টা পুরস্কারের ঘোষণা করেন বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কেও। কোনও ব্রিটিশকে মারতে পারলেই পুরস্কার। বোম্বে গভর্নরকে মারতে পারলেই এক লক্ষ টাকা। ইংরেজদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন বাসুদেব।
কিন্তু এই দেশের ইতিহাস, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসও বটে। এক গ্রামবাসী টাকার লোভে বাসুদেবের খবর দিয়ে দেন ইংরেজদের। ১৮৭৯ সালের ২০ জুলাই গ্রেফতার হন বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে। সশস্ত্র যুদ্ধের স্বল্প জীবন। তাতেই ইংরেজদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দেশের ঘুম ভাঙছে।
বিচার শুরু হয়। কিন্তু এই রবিনহুডের বিচারে সাক্ষী মেলেনি। তাই ক্যালেন্ডার ধরে, ঘটনা ধরে প্রহসনের বিচার চলে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু সে সময়ে দেশের কোনও কারাগারের ক্ষমতা হয়তো ছিল না বাসুদেবকে আটকে রাখার। এটা বুঝে ইয়েমেনের এডেন শহরে জেলবন্দি করে রাখা হয় তাঁকে। শোনা যায় ১৮৮৩ সালে, খালি হাতে জেলের দরজা ভেঙে পালিয়ে যান। যদিও অজানা অচেনা শহরে ধরাও পড়ে যান। কিন্তু বিপ্লবীর গোঁ। ধরা পড়ার পর খাবার মুখে তোলেননি। একপ্রকার অনশনেই চারদিন পর শহিদ হন বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে।
শুধু অস্ত্রই হাতে তোলেননি বাসুদেব। সশস্ত্র বিপ্লবে নামার আগে পুনে নেটিভ ইন্সস্টিটিউশন স্থাপন করেছিলেন ১৮৬০ সালে। যা পরবর্তীতে মহারাষ্ট্র শিক্ষা সংস্থায় পরিবর্তিত হয়। স্কুল খুলেছিলেন। দেশের তরুণদের মধ্যে সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে স্থাপন করেন ঐক্যবর্ধিনী সভা।
বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের মৃত্যু গভীর প্রভাব ফেলেছিল দেশে। বঙ্গদেশের এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটকেও নাড়া দিয়েছিল এই জীবন। তাঁর উপন্যাসে বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্র উঠে এসেছিল বাসুদেবের জীবন থেকে। সে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর সে উপন্যাস, আনন্দমঠ। বাসুদেবের জীবনের প্রত্যক্ষ প্রভাব যে ‘আনন্দমঠে’ রয়েছে, সেটা কানে গিয়েছিল ইংরেজদের। তাই লেখা সেন্সর করতে হয় সাহিত্য সম্রাটকে। কাঁচি চালিয়েই পরবর্তীতে পুনরায় প্রকাশিত হয় আনন্দনমঠ।
স্বাধীনতা লাভের ৭ দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর আজ এই মারাঠি বিপ্লবীর সমস্ত বলিদান বন্দি শুধুমাত্র ১৯৮৪ সালে ৫০ পয়সার ডাকটিকিট আর দক্ষিণ মুম্বইয়ে নামে একটি চকে।
August 15, 2020 from Ekhon Somoi
August 15, 2020 from Ekhon Somoi
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন