এরকমই নির্ভীক বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়েছিল খাস কলকাতার বুকে। সে ইতিহাস আজ অনেকটাই ফিকে। এককালীন "যুগান্তর" দলের হেড কোয়ার্টার ২৭ নম্বর কানাই ধর লেনে নেই সে স্মৃতির ছিটেফোঁটাও। যতটুকু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সে ইতিহাস, তার আনাচ-কানাচে এখনও বারুদের গন্ধ মেলে বৈকি! দরজার সামনে লেখা সেই বাড়ির ঠিকানা। তবে আজ সেখানে আর দেখা মেলে না উল্লাসকর,বারীনদের। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে টেরও মেলে না এক কালে এখানেই রণকৌশল ঠিক করত সশস্ত্র "যুগান্তর" দল।
পরে অবশ্য মানিকতলার বাগানবাড়ি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী "যুগান্তর" পত্রিকার আঁতুড়ঘর। সশস্ত্র বিদ্রোহের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়রা। বারীন্দ্র কুমার ঘোষের "যুগান্তর" দলের মূল আখড়া ছিল মানিক তলার বাগানবাড়ি। সেখানেই ডাল-ভাত ফুটিয়ে খেতেন বারীনরা। চলত অস্ত্র শিক্ষা, বোমা বাঁধার কাজ। উল্লাসকরের বানানো বোমা দিয়েই কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী।
এরপরই ৩২ নং মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে হানা দেয় ব্রিটিশ পুলিস। ধরা পড়ে যান বেশ কিছু বিপ্লবী। ১৯০৯ সালে রায় দেওয়া হয় "আলিপুর বোমা মামলার।" ফাঁসির সাজা হয় উল্লাসকর দত্ত ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষের। ফাঁসির সাজা শুনে উল্লাসকর গেয়ে উঠেছিলেন, "সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে।" পরে অবশ্য ফাঁসির পরিবর্তে "কালাপানিতে" ঠাঁই হয় উল্লাস, বারীন, হেমচন্দ্র, উপেন-সহ একাধিক বিপ্লবীদের।
সেকালে সেলুলার জেল ছিল "যমলোক।" কয়েদিদের রোজ ঘানি টেনে ১০ পাউন্ড সরষের তেল বা ৩০ পাউন্ড নারকেলের তেল পিষে বার করতে হতো। "জেলের যে অংশে তেল পেষা হয় দুই জন পাঠান পেটী অফিসার তখন সেখানকার হর্ত্তাকর্ত্তা। সেখানে ঢুকিবা মাত্র তাদের মধ্যে একজন তাহার বন্ধমুষ্টি আমাদের নাকের উপর রাখিয়া বেশ জোর গলায় বুঝাইয়া দিল যে কাজকর্ম্ম ঠিক ঠিক না করিতে পারিলে সে আমাদের নাকগুলি ঘুষার চোটে থ্যাঁবড়া করিয়া দিবে।" অবর্ণনীয় কষ্টের কথা বলতে গিয়ে "নির্বাসিতের আত্মকথা" বইটিতে এমন কথাই লিখে গিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়।
শুধু কি তাই! ইটের গোলায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে একবার উল্লাসকর ফিরেছিল ১০৪-১০৬ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে । তারপর তাঁকে ভাতের মাড় খাইয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেওয়ালের সঙ্গে। পরদিন সকালে দেখা যায় উল্লাসকর অজ্ঞান অবস্থায় হাতকড়ি থেকে ঝুলছে। বারীনের লেখা থেকে জানা যায়, জ্বর ছেড়ে যেদিন উল্লাসকর বেরিয়েছিলেন সেই আর আগের রাসিল সাহেবকে জুতো দিয়ে চাপকানো উল্লাসকর আর নেই, "তিনি আজ উন্মাদ।"
এভাবেই কলকাতা থেকে কালাপানি, বোমা বাঁধা হাতে জুটেছিল তেলের ঘানি। সেই স্মৃতি নিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ২৭ নম্বর কানাই ধর লেন। স্বাধীনতার আশেপাশের সময়ে বাড়িটিকে কর থেকে মুকুব করেছিলেন স্বয়ং রাজ্যপাল। তবে এই দুঃসাহসী গলিতে দ্রুত বিলীন হয়ে গিয়েছে ইতিহাস। নাম-চিহ্ন যা কিছু অবশেষ আছে সবই কাগজের জীর্ণ পাতায়।
August 15, 2020 from Ekhon Somoi
August 15, 2020 from Ekhon Somoi
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন